নেপালের কালাপনি সমস্যা, একটু চটকেই দিতে হবে চিনকে

0
696

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করলেন নীহাররঞ্জন চাকী

২০২০ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের বন্ধু-প্রতিবেশি নেপাল প্রকাশ করেছে তার নয়া ভৌগোলিক ম্যাপ। সেই ম্যাপে নেপাল ভারতের প্রায় ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে ঢুকিয়ে নিয়েছে নিজের দেশে। ভারতের পিথোরাগঢ় জেলার ব্রহ্ম পর্বতের অংশ ওই ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। এই এলাকায় রয়েছে লিম্পিয়াধুরা, লিপুলেখ, কুটি, গুঞ্জি এলাকাগুলি। জমির পরিমানটা যাই হোক না কেন, হঠাৎ করে নেপালের ফুসফুসে এত দম এলো কোথা থেকে? নেপালের ফুসফুসে হাওয়া আসছে কোথা থেকে?

নেপালের ইতিহাস নিয়ে নানান অভিমত রয়েছে বিদ্বজনদের। প্রাচীনকাল থেকেই হিমালয় এবং তার পাদদেশে বহু ছোট ছোট স্বাধীন রাজা ছিলেন। এঁদের মধ্যে রাজা নীলম্বর ওরফে ইলম, রাজা রঘু দেব প্রমুখ আনেকেই রয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। কাঠমান্ডু শহরের নামাকরণ হয় সম্ভবত রাজা গুণকাম দেবের রাজত্বে। কারণ তিনি ওই শহরে শাসন চালান ও বসবাসের জন্য কাঠের গাছ আকৃতির একটি বাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এর নাম ছিল কাষ্ঠমণ্ডপ। একথা সেই ৯৪৯-৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দের। কিরান্ত, কিরাত, ঠাকুরি, মল্ল, ইত্যাদি বহু রাজবংশ শাসন করেছেন নেপাল এলাকার বিভিন্ন এলাকা।

নেপাল জুড়ে ছোট ছোট অনেক রাজ্য ছিল এবং রাজাও ছিল সেখানে। কিন্তু বর্তমান চেহারার নেপালের জনক পৃথ্বী নারায়ণ শাহ। আধুনিক নেপালে তিনি রাজত্ব করেছেন ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৫ সাল অবধি। ১৭৬৯ সালে কাঠমান্ডুকে রাজধানী ঘোষণা করে ছোট ছোট রাজ্যগুলি দখল করে তৈরি হ্য় পূর্ণাঙ্গ বর্তমান নেপাল। পূর্ণাঙ্গ নেপালের প্রথম রাজা তিনিই।

তিনি রাজা হবার পর নেপালি জনগণকে শাসনের জন্য কিছু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দেন তিনি। রাজা পৃথ্বীনারায়ণ সেসময় বর্তমান নেপালের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে যতদূর পেরেছেন দখল করেছিলেন। পূর্বে সিকিম এলাকাসহ তিস্তা নদী ও পশ্চিমে গণ্ডকি পর্যন্ত এলাকা দখল করেছিলেন ১৮১৩ সালের মধ্যে।

কিন্তু ইংরেজ শাসকরা বসে থাকেন নি। তাঁরা পৃথ্বীনারায়ণের জবরদখল রাজনীতির বিরুদ্ধে কামান দাগলেন ১৮১৪ সালে নেপালের পশ্চিম দিক থেকে। এক বছরের মধ্যে হার মেনে নেন পৃথ্বীনারায়ণ এবং ইংরেজদের সঙ্গে বিহারের সুগৌলি এলাকায় আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৮১৫ সালের ২ ডিসেম্বর। যুদ্ধ শেষ। এই সন্ধি বা চুক্তি পুণরায় ১৮১৬ সালের ৪ মার্চ সংশোধিত হয়। একেই বলা হয় সুগৌলি চুক্তি। এই চুক্তি মোতাবেক পৃথ্বীনারায়ণ পূর্বে মেচি নদী থেকে পশ্চিমে কালী নদী পর্যন্ত এলাকা পেলেন নেপাল হিসেবে। পশ্চিমে কালীনদীর পশ্চিম প্রান্ত ঢুকে যায় আবার ভারতেই। পূর্বে মেচি থেকে তিস্তা পর্যন্ত এলাকা চলে আসে ভারতে এবং সিকিম অঞ্চল থাকে সিকিমরাজের হাতে। এই চুক্তি অনুযায়ি ব্রিটিশ ভারতের একজন প্রতিনিধি কাঠমান্ডুতে থাকার সুযোগ পেলেন। ১৮১৫ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে লিপুলেখ, কুটি, লিম্পিয়াধুরা ইত্যাদি এলাকা নিয়ে পুরো গণ্ডকি এলাকা এবং তরাইয়ের কিছু অংশ ভারতে ফিরে এলো। সুগৌলি চুক্তি (অনুচ্ছেদ ২, ৩ এবং ৪)অনুযায়ি বিবাদ শেষ।

১৯৫০ সালে ৩১ জুলাই কাঠমান্ডুতে ভারত নেপালের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ইন্দো-নেপাল ট্রিটি অফ পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ। এক কথায় ভারত-নেপাল শান্তি মৈত্রী চুক্তি। এই চুক্তি সুগৌলি চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে স্বক্ষরিত হয়। উল্লেখ্য, নেপালের কান্তিপুর পোষ্টের ১৩-০৮-২০১৯ সালে প্রকাশিত খবর অনুযায়ি এই দুটি চুক্তির কোনটারই আসল কপি নেপালে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

১৯৬২ সালে চিন ভারত আক্রমণ করে বসে। সে সময় সৈন্য বাহিনির পাশাপাশি চিনাদের ঠেকানোর জন্য ভারত সরকার সি আর পি এফ আইন মোতাবেক গঠন করেন ইন্দো তিব্বত সীমান্ত পুলিশ বা আই টি বি পি। এই ইন্দো তিব্বত সীমান্ত পুলিশ বা আই টি বি পি কে মোতায়েন করা হয়েছিল তখন ভারতের পিথোরাগঢ় জেলার ব্রহ্ম পর্ব্বত এলাকার তিব্বত সীমান্তের লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরা গিরিপথ এলাকায়। ১৯৬২ সাল থেকেই শান্তিতেই চলছে এই ব্যবস্থা। কোনোদিন কোন আপত্তি নেপাল বা চিন তোলে নি।

২০১৫ সালে চিন সফরকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও চিনা প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চূড়ান্ত হয় লিপুলেখ গিরিপথ দিয়ে ভারত চিন বাণিজ্য বৃদ্ধি করা হবে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কৈলাশযাত্রীদের জন্য এই গিরিপথ ব্যবহার করা হবে। লিপুলেখ ধেকে কৈলাশের দূরত্ব মাত্র ৬৪ কিলোমিটার। ২০১৫ সালের পর থেকেই লিপুলেখ রুটের সড়ক ব্যবস্থার উন্নতিকরণ নিয়ে নয়াদিল্লি চিন্তাভাবনা শুরু করে এবং দারচুলা (উচ্চতা প্রায় ৬ হাজার ফুট) থেকে লিপুলেখ (উচ্চতা প্রায় ১৭০৬০ ফুট) পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করে এবং মে মাসের ৮ তারিখ এই লিঙ্ক রোডের উদ্বোধন করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং।

এবারে নেপালের মাথাটা ঘুরিয়ে দেয় তাদের এক বন্ধু। নেপালে বর্তমানে চলছে নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টির সরকার। কম্যুনিস্ট কম্যুনিস্ট গলায় গলায় পিড়িত। কম্যুনিস্ট বন্ধুর হাতের তামাক খেয়ে “নেশা”র ঘোরে একটি নয়া ভৌগলিক ম্যাপ প্রকাশ করে বসে নেপাল মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এই নয়া ম্যাপে ভারতের পিথোরাগঢ় জেলার লিপুলেখ, কুটি, লিম্পিয়াধুরা ইত্যাদি এলাকার প্রায় ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ঢুকিয়ে দেয় নেপাল। তারাও বলে সুগৌলি চুক্তি মেনেই এই নয়া ম্যাপ।

অপ্রত্যাশিত ভাবে ফের শুরু হয় ভারত নেপালের মধ্যে শীত যুদ্ধ। নেপাল তো শারিরিক যুদ্ধের হুমকিও দেয় ভারত কে। কম্যুনিস্ট বন্ধুর “চিনা কম্বল” গায় দিয়ে গরম দেখাচ্ছে নেপাল। নেপালের নয়া ম্যাপের যুক্তি নিয়ে একটু আলোচনা করাই যেতে পারে।

নেপালের মতে, সুগৌলি চুক্তি অনুযায়ি কালী নদী বা শারদা নদীর উৎপত্তি কালাপানি গ্রাম নয়, লিম্পিয়াধুরা। কালাপানি গ্রাম থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে লিম্পিয়াধুরা গিরিপথ। কালাপানির কাছেই লিপুলেখ গিরিপথ। দুই গিরিপথের দুরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। লিম্পিয়াধুরা থেকে কালাপনি গ্রাম দিয়ে কালী নদী সমতলের দিকে ছুটেছে। উল্লেখ্য, কালী নদী মহাকালী ও শারদা নদী নামেও পরিচিত।

ইংরেজ শাসকরা তদানিন্তন নেপাল রাজা এবং তাঁর প্রশাসকদের চাইতে নিশ্চয়ই কম বিচক্ষণ ছিলেন না। কিংবা তদানিন্তন নেপাল রাজা এবং তাঁর প্রশাসকরা কূটনীতি কিছুই বুঝতেন না তাও নয়। তাঁরা ছিলেন বেশ দক্ষ। কালী নদী যদি সত্যিই লিম্পিয়াধুরা থেকে সূচনা হয়ে থাকতো তাহলে চুক্তিপত্রে কালী নদীর উৎসস্থল ১৮১৬ সালের ৩১ জুলাই থেকেই নেপালের ভৌগলিক মানচিত্রে স্থান পেত। এটা সোজা কথা। তাহলে নতুন করে নেপালের বর্তমান সরকারকে নেপালের ভৌগলিক মানচিত্র প্রকাশ করতেই হত না। হঠাৎ করে নেপালের নয়া মানচিত্রের প্রয়োজন দেখা দিত না। এই সাধারণ বিষয়টি নেপালকে বুঝতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির স্বার্থে।

বাস্তবে কালী নদী কালাপানি গ্রাম থেকেই শুরু হয়েছে। এই কালী নদী তৈরি হয়েছে কুঠিয়াঙ্কি নদী (ঝোরা) ও কালাপানি নদী (ঝোরা) মিলে। এই মিলন/সঙ্গম হয়েছে কালাপানি গ্রামে। কালাপনি নদীটি উৎপত্তি হয়েছে লিপুলেখ গিরিপথের কাছ থেকে। এখান থেকেই পরিস্কার, নেপাল সঠিক কথা বলছে না। আসলে নেপাল কে দিয়ে বলানো হচ্ছে। তাহলে নেপাল কি এখনও নাবালক? কিসসু বোঝে না?

নেপাল ভারতের কাজে সন্তুষ্ট নাও হতে পারে। ৮০ কিলোমিটার সড়ক নিয়ে আপত্তিও তুলতে পারে। সে কথা তো দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেই হতে পারত। নেপালের ইচ্ছেটা যদি সদর্থক হত তা্হলে নেপাল দ্বিপাক্ষইক বৈঠকের মাধ্যমেই কথা বলতে পারত। ভারত তো নেপালকে সামরিক থেকে সবদিকেই সহায়তা করে। ভারত-নেপালের মানুষের অবাধ যাতায়াত। এত কাছের সম্পর্ক ছেড়ে দখলের রাজনীতির পথিক কম্যুনিস্ট বন্ধু কেন?

আসলে নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে কম্যুনিস্ট চিন। উদ্দেশ্য ভারতকে একটু ব্যস্ত রাখা। এই উস্কানির খেলায় ব্যবহৃত হয়েছে নেপাল। নেপালকে তিব্বতে পরিণত করতে চায় চিন। এই ফন্দি দীর্ঘদিনের। নেপালে যখন যখন কম্যুনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে তখন তখন নেপাল ফন্দির শিকার হয়ে একটু ভারত বিরোধি হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রি পুষ্পকমল দাহালের (প্রচণ্ড) আমলেও একটু উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা হয়। এখন নেপালে কন্যুনিস্ট সরকার।

কোভিদ ১৯ (কোরনা ভাইরাস) নিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলে চিন বেশ বেকায়দায়। চিনের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র ১ নম্বর অভিযোগকারী। অভিযোগ নিয়ে হৈচৈ বেশ গড়াবে। এখানেই শেষ নয়, কোরনার প্রভাবে চিনের অভ্যান্তরিণ অর্থিক বাজারও বেশ মন্দা। ইতিমধ্যেই ২০ শতাংশ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে।

এক্ষেএে আবার ভারত সেইসব কোম্পানিগুলিকে ভারতে শিল্প গড়ার আহ্বান জানিয়ে স্বাগতের অপেক্ষায়। চিনের মাথা ব্যথার দ্বিতীয় কারণ এটি। নিজের দেশের মানুষের ক্ষোভের মোকাবিলায় ভারতকে সীমানা নিয়ে ব্যস্ত করে রাখা। ১৯৬২ সালেও চিনের অভ্যান্তরে নানান গোলযোগ শুরু হয়েছিল। সেই সময় চিন ভারতকে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু চিন ভুল করছে। ১৯৬২ সালের ভারতের চাইতে ২০২০ সালের ভারত অনেক বদলেছে। চিনের ভোঁতা মুখে ঝামা ঘষে দেবার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের।

“নেশার” ঘোরে নেপাল একটু উল্টোপাল্টা গাইছে। সুস্থ হলে নেপালে বোঝাতে ভারতের ১ ঘন্টাও লাগবে না। সমস্যা হল চিন। একটু সময় দিতে হবে ভারতীয়দেরও এবারে। ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতি আর সেনাদল তাদের মত কাজ শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। এবারে ভারতীয়দের নামতে হবে ময়দানে।

চিনের বিভিন্ন কোম্পানি ভারতে বার্ষিক মোট ৫ লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা করে। এই টাকার সমমূল্যের জিনিসপত্র ভারতের চিনা কোম্পেনি থেকে কেনেন ভারতীয়রা। এই টাকায় বলিয়ান হয়ে চিনা সৈন্যরা আমাদের সেন্যদের প্রাণ কেড়ে নেয়, ভারতের সীমানা অতিক্রম করে অশান্তি বাঁধায়।

মাঠে মারার পাশাপাশি, ভাতেও মারতে হবে চিনকে। ভারতীয়দের যেভাবে হোক চিনা পণ্য কেনা বন্ধ করতে হবে। যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, বিভিন্ন পোষাক, কসমেটিক্স, খেলনা, সফটওয়ার, যেমন শেয়ারইট, আলিবাবা ইত্যাদি। এমন বেশকিছু দ্রব্য বা পণ্য রয়েছে যা কি না ভারতীয়রা চিনা কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করা বন্ধ করে অন্য দেশের বা স্বদেশের সেইসব পণ্য সংগ্রহ করতে শুরু করতে হবে। চিনা পণ্যের ভারতীয় বাজার বন্ধ হলে চিনা কোম্পানিরাও তাদের কম্যুনিস্টদের যা বোঝানোর বোঝাবেই।

দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বক্ষেত্রেই অশান্তির কারণ চিনের কম্যুনিস্টদের আগ্রাসি নীতি। পাকিস্তানকে পাগল করে দিচ্ছে ভারতের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশকে ভড়কানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। নেপালকেও লেলিয়ে দিতে চাইছে। সবই আসলে ভারত বিরোধি অভিযান। চিনকে একটু “চটকে” দিতে পারলে ভারতের সুবিধা হবে আর্থিক বিকাশে। এবারে নিজেদের স্বার্থেই শুরু হোক চিনা পণ্য বয়কট। চিন শান্ত হলেই পাকিস্তান শান্ত হবে। নেপাল নেশা করবে না। শান্ত থাকবে দক্ষিণ এশিয়া।